নিশবেতগঞ্জের শতরঞ্জি রংপুরের র্ঐতিহ্য
Not allow reviews
নিশবেতগঞ্জের শতরঞ্জি পল্লী রংপুরের র্ঐতিহ্য, রংপুরের তাঁতিরা এক ধরনের মোটা কাপড় তৈরি করেন, যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি মূলত এক প্রকার কার্পেট
Descriptions
যেসব প্রাচীন বুননশিল্প এখনো টিকে আছে তার মধ্যে এই শতরঞ্জি অন্যতম। রংপুর জেলার গৌরবময় ঐতিহ্য ও প্রাচীন শিল্প এটি। নানা রং আর অপূর্ব নকশার সমন্বয়ে তৈরি ঐতিহ্যবাহী এ শিল্প একসময় হারিয়ে যেতে বসেছিল। তবে সরকারি-বেসরকারি প্রচেষ্টায় আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে শতরঞ্জি পল্লী। বেড়েছে শতরঞ্জির চাহিদাও।
একসময় রাজা-বাদশাদের গৃহে এর ব্যাপক কদর ছিল। মোগল সম্রাট আকবরের দরবারে শতরঞ্জি ব্যবহার করা হতো বলে ইতিহাস থেকে প্রমাণ মেলে। জমিদার-জোতদারদের ভোজের আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহারের কথা শতসিদ্ধ। সে সময়ে রাজা-বাদশা, বিত্তবানদের বাড়িতে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহার হতো।
রংপুর শহর থেকে পশ্চিমে সেনানিবাসের পেছনে শতরঞ্জি পল্লী। গ্রামের প্রায় হাজার পরিবার এ শিল্পে কাজ করে স্বাবলম্বী। শতরঞ্জি পল্লীতে কাজ করেন প্রায় ৩০০ কর্মী। রাতের গভীরেও শোনা যায় ছন্দায়িত শব্দের লহরা। খটখট শব্দের সঙ্গে তালে তাল মিলিয়ে কাজের মধ্যে ডুবে যান শতরঞ্জি পল্লীর তাঁতশিল্পীরা।
রংপুরের তাঁতিরা এক ধরনের মোটা কাপড় তৈরি করেন, যা শতরঞ্জি নামে পরিচিত। শতরঞ্জি মূলত এক প্রকার কার্পেট, একসময় অভিজাত শ্রেণির গৃহে, বাংলো বাড়িতে বা খাজাঞ্চিখানায় বিশেষ আসন হিসেবে শতরঞ্জি ব্যবহৃত হতো। বর্তমান আধুনিক সমাজে আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে এখনো ব্যবহার হচ্ছে শতরঞ্জি পল্লীর তৈরিকৃত শতরঞ্জি।
শতরঞ্জি ফার্সি ভাষার শতরঞ্জ শব্দ থেকে এসেছে। দাবা খেলার ছককে শতরঞ্জ বলা হয় এবং দাবা খেলার ছকের সঙ্গে শতরঞ্জির নকশার মিল থাকার কারণে শতরঞ্জি নামে নামকরণ করা হয়।
ঐতিহাসিক হান্টারের তথ্য অনুযায়ী, ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের মি. নিসবেত নামে এক ব্রিটিশ রংপুর জেলার কালেক্টর ছিলেন। তিনি রংপুরের পীরপুর গ্রামের শতরঞ্জি শিল্প দেখে মুগ্ধ হন এবং পরবর্তীতে এর গুণগত মানোন্নয়ন ও এ শিল্পের সম্প্রসারণে সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। জনশ্রুতি রয়েছে, তার নামানুসারেই তৎকালীন পীরজাবাদ মৌজার একাংশের নামকরণ করা হয় নিসবেতগঞ্জ। একসময়ে শতরঞ্জি পল্লীর তৈরিকৃত শতরঞ্জি ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো।
শতরঞ্জি পল্লীতে নারীরাই বেশির ভাগ সময় ব্যস্ত থাকেন শতরঞ্জি বুননে। বাড়ির কাজের পাশাপাশি গৃহবধূরা সুযোগ পেলেই বসে যান হাতের কাজ নিয়ে। এভাবেই রংপুরের নিসবেতগঞ্জের ঘরে ঘরে তৈরি হচ্ছে শখের শতরঞ্জি। শতরঞ্জি বুননের টাকায় যা আয় হয়, তা দিয়েই চলছে সংসার। হস্তজাত এই শতরঞ্জি শিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে তাদের জীবন-জীবিকা। প্রতিদিন একজন শ্রমিক ১০ থেকে ১৫ বর্গফুট শতরঞ্জি বুনতে পারেন। প্রতি বর্গফুটে তারা ১৫ টাকা থেকে ২৫ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন। শতরঞ্জি পল্লীতেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। শিল্প হিসেবে যেমন গড়ে উঠেছে, তেমনি গ্রামের মানুষের দারিদ্র্যও দূর করছে এই শতরঞ্জি। আর এ কারণেই গ্রামের নামটাই বদলে হয়েছে শতরঞ্জি পল্লী।
রংপুরের নিভৃত শতরঞ্জি পল্লীতে উৎপাদিত শতরঞ্জি সামগ্রী ঢাকার বেশ কয়েকজন রফতানিকারকের মাধ্যমে চলে যাচ্ছে ইউরোপের বাজারে। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে স্থানীয় শ্রমিকদের ডিজাইনে করা শতরঞ্জি রফতানি করে প্রতি বছর অর্জিত হচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা। রংপুরের ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি এখন দেশের সীমানা ছাড়িয়ে জায়গা করে নিয়েছে ইউরোপের বাজারও। অথচ একটা সময় ছিল যখন বাজার না থাকায় এই শতরঞ্জি পল্লীর শিল্প পড়েছিল হুমকির মুখে। শত বছরের ঐতিহ্যবাহী এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন কারুশিল্পীরা। দেশ-বিদেশে বাজার তৈরি হওয়ায় এখন আবারও জমে উঠেছে শতরঞ্জ পল্লী।
ব্রিটিশ শাসনামলে এটি এত বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করে যে, শতরঞ্জি পল্লী এর তৈরি শতরঞ্জি ভারতবর্ষ, মিয়ানমার, সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হতো। প্রতি বছর ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যে পরিমাণ কারুশিল্প সামগ্রী রফতানি হয়, তার ৫০ ভাগই শতরঞ্জিই হচ্ছে এই শতরঞ্জি পল্লীতে থেকে উৎপাদিত। রফতানি হচ্ছে বিশ্বের ৩৬ দেশে। বছরে আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদত মোহাম্মদ সায়েমের নির্দেশে প্রথম সরকারিভাবে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে নিসবেতগঞ্জ গ্রামে শতরঞ্জি তৈরির প্রকল্প গ্রহণ করে। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৫ সালে প্রথম সরকারিভাবে বিসিক শতরঞ্জি পল্লীতে জড়িত ৪৫ জন শ্রমিককে কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হয়। এরপর থেকে অবধি অবহেলিত শতরঞ্জি পল্লী সরকারের দৃষ্টিতে আসেনি। ইতিবাচক সহযোগিতা পেলে এই নান্দনিক শিল্পটি বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ নানামুখী সহযোগিতা এবং বেকারত্ব সরানোর কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।